অনন্যা এই প্রথম আবিষ্কার করল নিজেকে। উপলব্ধি করল সে এখনও জীবিত। শ্বাস নিচ্ছে। বুকটা ঠিকই উঠা নামা করছে। ডান হাতটা নাকের কাছে নিয়ে আদৌ বেঁচে আছে কিনা দেখতে গিয়েও পারল না। হাতটা বড় একটা দেয়ালের নীচে চাপা পরে আছে।
খুব বেশী কিছু মনে করতে পারছে না। কি হয়েছে কিভাবে হয়েছে কিছুই ভাবতে পারছে না। যে মেশিনটাতে কাজ করছিল তার নীচেই শুয়ে আছে। পা দু’টো তুলতে পারছে না। কারা যেন শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। কেবল এটুকু মনে করতে পারল যে অনেক রাত হয়েছে। এবার বাসায় যাওয়া দরকার। তমাল নিশ্চয় এতক্ষণ ফিরে এসেছে। এসেই কিছু খেতে চাইবে। সকালের রান্না করা তরকারিটা গরম দিতে হবে। আমার দেরি দেখে কোথায় নিজে থেকে দুটো ভাত বসিয়ে দেবে, তা না। বলে কি না, রান্না বান্না নাকি মেয়েদের কাজ। তুমি যা রান্না কর তাইতো অমৃত। আমার ওসবে নাক গলানোর দরকার নাই।
আজ কি ছুটি দেবেনা। আর কত ওভারটাইম করতে হবে। সকালে ম্যানেজার যেভাবে কাজ করতে বাধ্য করেছিল তাতে মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। আমরা শ্রমিক বলে কি আমরা মানুষ নই। মনে হচ্ছে বেঁধে রেখে কাজ করাচ্ছে। কলুর বলদের মত সারাদিন শ্রমিকরা পরিশ্রম করবে আর রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবে মালিকরা। ম্যানেজার বলেছিল অনেক অর্ডার আছে। ঠিকমত শিপমেন্ট করতে হলে দিনে রাতে কাজ করতে হবে। প্রোডাকশন বাড়াতে হবে। প্রোডাকশন না হলে অর্ডার বাতিল হয়ে যাবে।
কিন্তু সবকিছু চুপচাপ কেন। ফ্লোরে হাসি তামাসা নেই। প্রোডাকশন ম্যানেজার আসার সময় মেয়েরা মুখ টিপে হাসত। লোকটার বদনজর আছে। মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে কথা বলত। লাইন সুপারভাইজারও নেই। খবরদারিও নেই। চারপাশ থেকে কেবল গোঁ গোঁ শব্দ, আর্তনাদ আর চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। র্গ র্গ র্খ র্খ মেশিনের শব্দ নেই। সবাই কেমন নির্জীব। জবু থবু হয়ে আছে। জীবনে এতগুলো লোককে একসঙ্গে কখনও উপরওয়ালাকে এভাবে ডাকতে শুনেনি অনন্যা। বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্তচিৎকার করছে অনেকে। সেই সাথে কান্নার রোল।
আমি কি বেঁচে আছি। অনন্যা একমুহুর্ত ভাবল। তা নাহলে আমি আমার হাত পা নাড়াতে পারছি না কেন। তা ছাড়া আজ বেতনটা নিয়ে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। অনন্যা বলেছিল মে দিবসের বন্ধের দিন যাবে। তমাল শোনেনি। বলেছে সে অনেক দেরী। শুভ কাজে দেরী করতে নেই। তাছাড়া এই প্রথম আমরা মা বাবা হতে যাচ্ছি। কোন রকম অবহেলা করা চলবে না। মে দিবসের বন্ধের দিন আমরা শুধু বেড়াবো। শ্রমিকদের জন্য এই একটা দিন বরাদ্ধ। কোন কাজ করব না। বাইরে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খাব। নো রান্না বান্না। বিয়ের চার বছর পর এই প্রথম অনন্যা মা হতে চলেছে। পাঁচ মাস চলছে। চেক-আপ করতে হবে। তলপেটের নীচের দিকে এক ধরনের চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে। খুব ভয় করছে অনন্যার। শরীরটা এমন লাগছে কেন। বড় কিছু ঘটেনিতো। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। ক্রমশ: ব্যথাও বাড়ছে। তলপেটের নীচ দিয়ে নাড়ি ভুঁড়ি সব যেন বেরিয়ে আসছে। তলপেটে ব্যথা মানে এভরশন হয়ে যায়নি তো। তমাল শুনলে নিশ্চয় খুব কষ্ট পাবে। আবার জ্ঞান হারিয়েছে অনন্যা।
সাভারের রানা প্লাজার ছয় তলায় ইথার টেক্সটাইলে কাজ করে অনন্যা। বিল্ডিং-এ ফাটলের কথা শুনে আসতে চায়নি। একটা ভয় কাজ করছিল। তমালও বারণ করেছিল। না গিয়েও উপায় নেই। ম্যানেজার বলেছে কাজ না করলে চাকরী থাকবে না, হাজিরা বোনাস দেবে না, বেতন দেবে না। আশ্বস্ত করে বলল- ভয়ের কিছু নাই। কপালে মরণ থাকলে কেউ ঠেকাতে পারবে না। তাছাড়া যা একটু ফাটল ছিল তা প্লাস্টার করে মোরামত করা হয়েছে। নিরুপায় হয়ে অনেকের মত অনন্যাও কাজে যোগ দিয়েছে। মাস শেষে এই টাকাটা না পেলে সংসার চলবে কিভাবে।
কতক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকা যায়। শুয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মনে হচ্ছে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। খসখসে জিহ্বাটা চেটে চুটেও কোনভাবে গলাটা ভিজাতে পারছে না। এই বুঝি মরে যাচ্ছি। বার বার বাড়ীতে অসুস্থ মা আর ছোট বোনটার কথা মনে পড়ছে। বাবা নেই। অনন্যার এই তিনজনের সংসার। ভালোবেসে বিয়ে করেছে তমালকে। ছোট বোনটাকে স্কুলে ভর্তি করেছে। স্কুল ড্রেস দরকার। এই মাসে কিনে দেবে বলেছে। মাকে ডাক্তার দেখানোর কথা। কি সব আবোল তাবোল ভাবছে। পানি বলে অস্ফুট শব্দ করল। তাতে কোন কাজ হল না। কেউ শোনেনি। পায়ের দিক থেকে কে একজন বাঁচাও বাঁচাও বলে পায়ে খামছি দিচ্ছে। সম্ভবত শিউলি। কি হয়েছে শিউলির। এত জোড়ে খামছি দিচ্ছে যে পায়ে খুব লাগছে। নখের আঁচড় বসে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেও পা টা নাড়াতে পারছে না। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। বাঁ হাতটা কোনভাবে টেনে তলপেটের উপর রাখল। না কিছুই হয়নি। ডান দিকে হাত ঘুরিয়ে কোমরের নীচে হাত দিয়ে দেখল। হাতে তরল জাতীয় কোন পদার্থের স্পর্শ লাগল।
প্রচণ্ড শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আবার মাঝে মধ্যে কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে। উপরে জোড়ে জোড়ে হাতুড়ি পেটার শব্দ। বিদঘুটে সব শব্দ। লোহা কাটার শব্দ। কারা যেন উপর থেকে চোখের উপর জলের ছিটা দিচ্ছে। তাতে ঠোঁটের উপর কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরল। শুকনো গলাটা একটু ভিজিয়ে নিল। চোখ খুলতে পারছে না। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। কোনরকমে চোখে মেলে তাকাতেই শিউড়ে উঠল সারা শরীর। রক্ত। অনেক রক্ত। জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। তাহলে কি পেটের সন্তানটা নষ্ট হয়ে গেলো। আর কিছুই ভাবতে পারছে না। কোন শব্দ কতে পারছে না। কেবল চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে। সে জল যখন ঠোঁটের কোণায় এসে জমা হচ্ছে তা জিহ্বা দিয়ে টেনে গলাটাকে ভিজিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানে না অনন্যা। এখন দিন না রাত তাও বুঝতে পারছে না। আশে পাশে আরও কয়েকজন গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। কে কিভাবে এখনও এখানে এই অবস্থায় আছে কিছই বুঝতে পারছে না। পায়ের দিক থেকে কে একজন পানি চাইল। গলার স্বর বুঝা যাচ্ছে। সম্ভবত মনিকা। একই ফ্লোরে পাশাপাশি কাজ করে। কিছুক্ষণ পর মনিকাও চুপ হয়ে গেল। কোন শব্দ করছে না। হাত পাও নড়ছে না। অনন্যা পা দিয়ে নাড়াতে চেষ্টা করল। পারছে না। নিথর দেহটা পরে আছে অনন্যার পায়ের উপর। আহারে বেচারি। এই সামনের মাসে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তাও বুঝি আর হলো না।
তীক্ষ্ণ একটা টর্চের আলো এসে পরল চোখের উপর। অনন্যা আবার নিজেকে আবিষ্কার করল। মাথার উপরে একটু ফাঁকা জায়গা। মেশিনের নীচে পা দু’টো চাপা পরে আছে। শ্রমিক বলে কথা। হাত পা গুলো যতক্ষণ সচল থাকবে ততক্ষণ দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে। এই মেশিনগুলোর উপর শ্রমিকদের যত ভালোবাসা। অনন্যাও তাই করত। কখনও ধুলার আস্তর পরতে দিত না। বলত এটাই তো আমার ভাতঘর। বাবার কাছে শিখেছি, যে কাজই করি না কেন সেটার যতœ নিতে হয়। আজ এই মেশিনটাও অনন্যাকে ছেড়ে যায়নি। অনন্যাকে চেপে ধরে রেখেছে। অনন্যা ঢালুর দিকে আর দু’হাত গেলে ডান হাতের মত মাথাটাও চাপা পরত। মেশিনের নীচে কোমর পর্যন্ত আটকে থাকাতে আর গড়িয়ে যেতে পারেনি। ভবনটা ধ্বসে পরেছে। কয়েক মুহূর্তের বিভীষিকাময় ধ্বংসযজ্ঞটা মুহূর্তের জন্য মনে পরল। অনন্যা এভাবে পরে আছে আজ দু’দিন। পাশে কোথায় যেন মোবাইল ফোনটা অনবরত বেজে যাচ্ছে। নিজের ভিতর এক অমিয় শক্তির ধারা সঞ্চারিত হলো। না আমাকে বাঁচতে হবে। আমার পেটে যে আমাদের সন্তান আছে। সর্বশক্তি দিয়ে সৃষ্টিকর্তার নামে চিৎকার করে বলল - আমাদের বাঁচান। আমরা বাঁচতে চাই।
উদ্ধারকর্মীরা যখন অনন্যাকে টেনে তুলছিল তখন বলছিল আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুক। স্ট্রেচারে করে বাইরে এসে ভোরের আলোটা চোখে পরতেই চোখ মেলে ধ্বংসস্তূপ দেখে আবার জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফেরার পর দেখল হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে অনন্যা। পাথরের মত দু’টো চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে পানি। ডান হাতটা কেটে ফেলা হয়েছে। তমাল গভীর ভালোবাসায় পাশে বসে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে।
শ্রমিকের শক্তি হচ্ছে দু’টো হাত দু’টো পা। ডাক্তার বলছে-বাম পাটা কাটতে হতে পারে। শক্ত পোক্ত দু’টো হাত পা না থাকলে শ্রমিকদের কেউ কাজ দেয় না। এভাবেই বুঝি বাকী জীবনটাই ছুটি কাটাতে হবে। কিভাবে চলবে বাকী জীবন। তমাল একা কতটুকুই বা করতে পারবে। এভাবে বোঝা হয়ে থাকার চেয়ে মরে গেলে ভালো হতো। বোবা কান্নার বুকফাটা আর্তনাদে আবার ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করল অনন্যা।
সাভার ট্রাজেডিতে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে উৎসর্গীকৃত। তারিখ: ২৯ এপ্রিল ২০১৩। জামালখাঁন, চট্টগ্রাম।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জাকিয়া জেসমিন যূথী
সাভারের ঘটনা সহজে ভোলা যাবেনা এই জীবনে। এই গল্প শুধু এই একবার নয়, বারে বারে উঠে আসবে আমাদের স্মৃতির পাতায়। লেখার খাতায়। ভালো লিখেছেন।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।